বিশেষ প্রতিনিধি, রংপুর :
তামাক শুধু একটি পণ্য নয়, এটি মৃত্যুর অন্য নাম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, তামাক ব্যবহারে প্রতিবছর বিশ্বে ৮০ লাখ মানুষ মা*রা যায়। বাংলাদেশে এই সংখ্যা বছরে ১ লাখ ৬১ হাজারের বেশি। আর এই নীরব ঘাতক, তামাকের প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্রগুলো যখন জনবসতিপূর্ণ এলাকার বুকে গড়ে ওঠে, তখন তা শুধু একজন নয় প্রজন্মের পর প্রজন্মকে ঠেলে দেয় স্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিপর্যয়ের অতল গহ্বরে।
রংপুর শহরের সিও বাজার ও সদর থানার পাগলা পীর-ডালিয়া রোড সংলগ্ন এলাকায় অবস্থিত একাধিক তামাক কোম্পানির ক্রাসিং ও মিক্সার মিল আজ তেমনই এক বিষবৃক্ষ, যার ছায়ায় শিশুরা হাঁপানিতে কষ্ট পায়, নারী ও বৃদ্ধরা ভুগছেন নানা দুরারোগ্য ব্যাধিতে।
যে এলাকাগুলো এক সময় ফাঁকা ছিল, এখন তা পরিণত হয়েছে ঘনবসতিপূর্ণ আবাসিক ও শিক্ষা-নির্ভর এলাকায়। এলাকার অনেক শিশুদের কণ্ঠেষব এখন শুধুই কাশির শব্দ। ডালিয়া রোড, মহাদেবপুর, চওড়াপাড়া—এই এলাকায় শত শত পরিবার, শিক্ষা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এর মাঝখানে অবস্থিত এসব অবৈধ তামাক কারখানা যেন নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে চালিয়ে যাচ্ছে দোর্দন্ড প্রতাপে।
স্থানীয় বাসিন্দা একজন শিক্ষক সাংবাদিকদের জানান, “আমার স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির একজন ছাত্রী অসুস্থ হয়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়ে চিকিৎসাধীন। ডাক্তারের রিপোর্ট বলছে, তামাক ধূলিতে তার ফুসফুসে সংক্রমণ। প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা ও মানুষের অসচেতনতার কারণে,সয়ে যেতে হচ্ছে আমাদের!
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেল, ডালিয়া রোডের মহাদেবপুর, চওড়াপাড়ায় অবস্থিত একটি বড় তামাক কারখানা, সাইনবোর্ড নেই, ভিতরে প্রবেশের সুযোগ না মিললেও বাইরে থেকে দেখা যায়, বিশাল এলাকা জুড়ে টিনশেডে সংরক্ষিত তামাক ক্রাসিং ও মিক্সারের গুঁড়া উড়ছে বাতাসে। বিকেল হতেই শ্রমিকরা বেরিয়ে আসেন—মাথা থেকে পায়ের পাতায় তামাকের গুঁড়ায় ঢাকা।
কারখানার মালিক আলহাজ্ব আক্তার হোসেন সাংবাদিকদের জানান,“আমরা সবাইকে ম্যানেজ করেই ব্যবসা করি। সাংবাদিকরা এলে তাদেরকেও আমরা সম্মান করি।’ আপনারা এসেছেন, আমার অফিস রুমে বসেন কথাবলি।’
তবে শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করতেই তিনি উত্তেজিত হয়ে বলেন, “তাদের সঙ্গে কথা বলার দরকার নেই। আপনারা চলে যান।”লাইসেন্সহীন উৎপাদন, শ্রমিকদের ন্যূনতম সুরক্ষা নেই, কারখানার অফিসে ঝুলে থাকা কোনো লাইসেন্স বা পরিবেশ ছাড়পত্র দেখা যায়নি। ভেতরে আধুনিক যন্ত্রপাতি নেই, নেই শ্রমিকদের জন্য কোনো স্বাস্থ্যসুরক্ষা ব্যবস্থা। ১২-১৩ ঘণ্টা কাজ করেও শ্রমিকরা পান মাত্র ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা, আর চুক্তিভিত্তিক কাজের শ্রমিকরা পান ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকা।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের উপ মহাপরিদর্শকের একাধিকবার সাক্ষাৎ চেয়ে না পেলেও, একজন মধ্যম পর্যায়ের কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “এখানে বেশিরভাগ কারখানারই কোনো লাইসেন্স নেই। আমরা তথ্য জানি, কিন্তু উপরের চাপের কারণে কিছু করা যায় না।”
রংপুর জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আব্দুস সালাম সরকার বলেন, “বহু পূর্বে দুই একটি কারখানার ছাড়পত্র নিলেও, অন্য সকলের ছাড়পত্র নেই। তবে কারখানার নির্দিষ্ট সংখ্যা বা কোন-কোনটির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, সেটা এখনই বলতে পারছি না।’ আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখছি।’
পরিবেশবিদ মো. রাশেদুল ইসলাম বলেন—“তামাক প্রক্রিয়াকরণ এলাকাগুলো যেন বিষবাষ্পে ঢাকা। এটি কেবল বায়ু নয়, মাটি, পানি এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বাস্থ্যকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। অতি দ্রুত এগুলো জনবসতি থেকে সরিয়ে নির্দিষ্ট শিল্প এলাকায় স্থানান্তর না করলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।”
এই অনুসন্ধান বলছে, আইন আছে, কিন্তু প্রয়োগ নেই। মালিকপক্ষ বলছে “ম্যানেজ”—যার অর্থ, প্রশাসনের নীরবতা কোনো দুর্ঘটনা নয়। এই ‘ম্যানেজ’ শব্দটাই যেন আইনের ব্যর্থতার প্রতীক। লাইসেন্সহীনভাবে চালানো তামাক কারখানাগুলোর বিরুদ্ধে নেই কোনো কার্যকর অভিযান, নেই মোবাইল কোর্ট, নেই গণশুনানি।
ব্যবস্থা না নেওয়ায়, ক্ষতি হচ্ছে পরিবেশের। স্বাস্থ্য ও শিশু অধিকারের দিক থেকেও এসব তামাক ক্রাসিং কারখানা আজ এক ভয়াবহ হুমকি। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, পরিবেশ অধিদপ্তর ও কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তরের উচিত একটি সমন্বিত কমিটি গঠন করে জরুরি ভিত্তিতে—লাইসেন্সবিহীন কারখানা চিহ্নিত করা,মোবাইল কোর্ট পরিচালনা, শ্রমিকদের স্বাস্থ্যসুরক্ষা নিশ্চিত করা ও নির্দিষ্ট শিল্পপার্কে কারখানা স্থানান্তরের সময়সীমা নির্ধারণ।
তা নাহলে শুধু একটি প্রজন্ম নয়, ভবিষ্যৎ বংশধরদের ফুসফুসেও প্রতিনিয়ত বিষ ঢেলে দিয়ে যাচ্ছে-এই তামাক কারখানাগুলো। এখনই জবাবদিহি না চাইলে, খুব শিগগিরই রংপুর শহরের বাতাসেই লুকিয়ে থাকবে মৃত্যুর হিসাব।
মন্তব্য করুন